দুর্নীতি কমানোর জন্য নির্বাচনী প্রচারণার খরচ কমানোর উপায়
যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তাদের আত্মজীবনী, তারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিভাবে অর্থ উপার্জন করেছেন তাদের পারিবারিক অবস্থা এবং অর্থ সম্পদের বিবরণী, এবং তাদের নির্বাচনী ম্যানুফেস্ট অথবা তারা নির্বাচনে জয়ী হলে দেশের জন্য এবং জাতির জন্য কি করতে পারবে তা তারা যেন জাতীয় টেলিভিশনের মাধ্যমে অথবা ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে জাতিকে জানাবে এবং সেটা তাদের নির্বাচনী এলাকার সবাই জানতে পারবে। সেই পুরা খরচটি সরকারকে বহন করতে হবে। তাই ১০০০ যদি প্রার্থী থাকে ৩০০ টি আসনের জন্য তাদের জন্য ১০০০ ঘন্টার এয়ার টাইম কিনতে হবে। এবং সেটা বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। সেটাই হবে একমাত্র নির্বাচনের প্রচারণা এর বাইরে কেউ কোটি টাকা খরচ করে অন্য কোন ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা করতে পারবে না। যাতে কিছুটা দুর্নীতি লাঘব করা যায়। কারণ যারা কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাবে তারা তার দ্বিগুণ পরিমাণ আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করবে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে দুর্নীতির মাধ্যমে।
আগামী নির্বাচনের রাজনীতি
✍️ প্রফেসর ড. শেখ আকরাম আলী
নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র স্বীকৃত পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জনগণ আন্তরিকভাবে চায়, সরকার পরিবর্তনে যেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতায় তারা নির্বাচনের নোংরা রাজনীতির সবচেয়ে তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করেছে।
যদিও জনগণ বর্তমানে দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়েছে, তথাপি তারাই এখনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। অনেক দিন ধরেই জনগণ একটি নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থানের স্বপ্ন দেখে আসছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ পায়নি।
স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-পরবর্তী অভিজ্ঞতা জনগণের জন্য বিশেষভাবে সুখকর ছিল না। শেখ মুজিবকে সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থার বিনাশের অন্যতম নায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, অপরদিকে শহীদ জিয়াউর রহমানকে দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার অগ্রদূত হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে তার জীবদ্দশায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচন প্রকৌশলের তেমন কোনো অভিযোগ দেখা যায়নি। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৮টি আসন পেয়ে বিরোধী দলে পরিণত হয় এবং মুসলিম লীগ ও আইডিএলও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন লাভ করে। মুসলিম লীগের সভাপতি খান এ সবুর খুলনার তিনটি আসন থেকে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে একটি নজির স্থাপন করেন।
জিয়াউর রহমানের পতন এবং এরশাদের উত্থানে নির্বাচনের চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়, এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এক গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদ প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন তার দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা ও যোগ্যতা প্রমাণ করেন এবং দেশের জনগণ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যক্ষ করে।
বিএনপি, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে, জামায়াতে ইসলামী’র নিঃশর্ত সমর্থনে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু পরে জামায়াত একই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে যোগ দেয় এবং ১৯৯৬ সালের জুনে তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসে। শীঘ্রই জামায়াত তাদের রাজনৈতিক ভুল উপলব্ধি করে এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যুক্ত হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে এই জোট বিশাল সাফল্য লাভ করে।
পরবর্তীতে কিছু রাজনৈতিক ভুলের কারণে বিএনপি নির্বাচনী অঙ্গনে ছিটকে পড়ে এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতির শিকার হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট শাসন ভারতীয় পরামর্শ ও সহায়তায় বিএনপিকে নির্বাচনী রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও তারা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশলের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। আসলে শুধু আওয়ামী লীগই নয়, বরং ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন শেখ হাসিনার পেছনে ছিল তার উত্থান থেকে ২০২৪ সালের পতন পর্যন্ত। এই সমর্থন তাকে টানা পনেরো বছর ক্ষমতায় রাখে, যতক্ষণ না তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে “তার গুরুর” আশ্রয়ে যান।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিলেও এখনো তা বাস্তব রূপ পায়নি। ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার একটি সুস্থ সমাজ-রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে আন্তরিক বলে মনে হলেও, এখনো কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি বা চূড়ান্ত সমঝোতা দেখা যায়নি। যে বিপ্লবের জন্য জাতি এত ত্যাগ স্বীকার করেছে—প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে—তা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’, যা পরিবর্তন ও সংস্কারের ভিত্তি হতে পারতো, তা এখনো ঘোষণা করা হয়নি। কেন বিলম্ব হচ্ছে—তা জাতির অজানা।
জাতি নিরলসভাবে অপেক্ষা করছে সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য, কিন্তু তা এখনো বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে বলে মনে হচ্ছে। মনে করা হয়, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং বর্তমান সরকার একসঙ্গে চাইলেই জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারে।
বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনটি দল সক্রিয় এবং প্রতিটি দলই ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে, তবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য নির্বাচনের মাধ্যমে তারা পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে।
সম্প্রতি লন্ডনে ড. ইউনুস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের রাজনীতি কার্যত শুরু হয়ে গেছে। এই নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রকাশ্য ও গোপন উভয়ভাবেই ঘটছে।
অনেকের মতে, বিএনপি তাদের পুরনো মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে এবং কিছু নতুন রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করে একটি বৃহৎ জোট গঠনের চেষ্টা করবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন এই জোট, প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াত-নেতৃত্বাধীন সম্ভাব্য জোটের তুলনায় বড় ব্যবধানে বিজয়ী হতে পারে।
নবগঠিত এনসিপি (NCP)-এর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—তারা কি একা লড়বে, না কি কোনো জোটে যোগ দেবে? কেউ বলছেন, তারা জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেবে, আবার কেউ বলছেন, লন্ডনের বৈঠকে ড. ইউনুসের মাধ্যমে ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছে।
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচনের ভবিষ্যৎ রাজনীতি পরিষ্কার হতে পারে। তবে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের জন্য বিরোধী দলে থেকেই উত্থান ও বিকাশ হওয়াটাই অধিকতর সহায়ক।
বাংলাদেশের রাজনীতি প্রমাণ করেছে এটি অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়—বিশেষ করে যখন এর একটি প্রভাবশালী প্রতিবেশী রয়েছে, যাকে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি স্থায়ী হুমকি হিসেবে দেখা হয়।
বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলই এককভাবে এই শক্তিশালী প্রতিবেশীর মোকাবিলা করতে পারবে না। তবে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি পরিপক্কতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে এই হুমকি মোকাবিলা করতে সক্ষম।
যেসব দেশ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত, তাদের সঙ্গে আগ্রাসী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
ভারত আগামী নির্বাচনের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করবে—এমন আশঙ্কা প্রবল। ধারণা করা হচ্ছে, তারা ইতোমধ্যে দেশের প্রধান জাতীয়তাবাদী শক্তির ভেতরে তাদের প্রভাব বিস্তারকারী এজেন্ট ঢুকিয়ে দিয়েছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সব রাজনৈতিক দলকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। আমাদেরকেও ভারতের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ সম্পর্কে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।